রাশিয়াসাবমেরিন

রাশিয়ার পারমানবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন

বর্তমানে নৌবাহিনী জন্য সাবমরিন সবথেকে শক্তিশালী যুদ্ধযান৷ শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করতে সাবমেরিনের মতো কার্যকরী যান আর একটিও নেই৷ কিন্তু এই সাবমেরিনে সামান্য ভুল বা সমস্যার কারনে ঘটে যেতে পারে ভয়ংকর দুর্ঘটনা ৷ আজকে এমনি একটি দুর্ঘটনার ইতিহাস জানাবো, যেটায় রাশিয়ার পারমানবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন কুরস্ক(কু-রো-স্ক) এর মধ্যে সামান্য রাশায়নিক বিক্রিয়ায় ঘটে যায় ভয়ংকর এক দুর্ঘটনা এবং পানির নিচে অক্সিজেনের অভাবে ৯৫ নাবিককে বরন করতে হয় নির্মম করুন পরিনতি৷

১২ আগস্ট ২০০০ সাল৷ সকাল রাশিয়ার নৌ-বহরের নিজেদের মহরা শুরু হয় । এই মহরায় নৌ-বহরের প্রতিপক্ষ ছিল রাশিয়ার একটি সাবমেরিন যার নাম ছিল কুরস্ক কে-১৪১(উচ্চারনঃ কে ওয়ান ফোরটি ওয়ান)। রাশিয়ান বহরের অন্যতম রনতরী “পিটার দি গ্রেট” এর বিপক্ষেই প্রথমে মহড়া শুরু হয় । ৫ বছর ধরে সাবমেরিনটির দায়িত্বে আছেন ল্যাফটেন্যান্ট ক্যপ্টেন দিমিত্রি কালা-শনি-কভ ।

ভিডিওটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন

মহড়া শুরুর কিছুক্ষন পরেই ক্যপ্টেন লিয়াক-শন সাবমেরিনের গতি কমিয়ে ঘণ্টায় ৮ নটিকেল মাইল করার নির্দেশ দেন । এরপর তিনি ৯০০০ পাউন্ডের ৬৫-৭৬ টর্পেডো, যেটা ফ্যাটগার্লনামে পরিচিত, সেটি নিক্ষেপের জন্য প্রস্তুতির আদেশ দেন । এই টর্পেডোগুলো কেরোসিন তেল দ্বারা প্রোপেলড হয় কিন্তু এটি সমুদ্রের তলদেশ থেকে নিরাপদে নিক্ষেপের জন্য প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয়

আর এই শক্তি যোগানের জন্য টর্পেডোগুলোতে ব্যবহার করা হয় “হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড” । এটি খুবই সাধারন একটি যৌগ । কিন্ত উপযুক্ত পরিবেশে কপার অথবা ব্রাস এর সংস্পর্শে এলে এটি অতি মাত্রায় ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে । টর্পেডো ছোড়ার আগ-মুহূর্তে হটাৎ ব্যাপক শব্দে টর্পেডো রুমে একটি টর্পেডো বিস্ফোরিত হয়

সেখানকার তাপমাত্রা মুহুর্তেই ৫০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌছায় । এর কিছুক্ষন পরেই একসাথে আরো চারটি টর্পেডোর বিস্ফোরন হয় । শক্তিশালী সাবমেরিনটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ধীরে ধীরে ব্যারেন্টস সাগরের ৩৩০ ফুট নিচে সমুদ্র পৃষ্টতলে পতিত হয় । এত বড় বিস্ফোরনেও কিন্তু সাবমেরিনের নিউক্লিয়ার রিএক্টরের কোন ক্ষতি ই হয়নি । সাবমেরিনের ১১৮ জনের মধ্যে ২৩ জন বাদে সকলেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। কুরস্ক অনেকগুলো কম্পার্টমেন্টে বিভক্ত ছিল ।

এর মধ্যে ৪ টি কম্পার্টমেন্ট কোন ক্ষতির সম্মুখিন হয়নি । নিয়ক্লিয়ার টার্বাইনটি তখনো সচল ছিল, যদিও কুরস্কের পক্ষে কোনভাবেই আগানো সম্ভব ছিল না৷ উল্টো টার্বাইনটি অ্যাকটিভ থাকায় ধীরে ধীরে পানি ঢুকতে শুরু করে । তাছাড়া সেই মুহুর্তে সমুদ্রের ৩৩০ ফুট নিচে থাকায় কম্পার্টমেন্টগুলোতে পানির ব্যাপক চাপ অনুভুত হতে থাকে । এমন কঠিন মুহূর্তে ল্যাফটেন্যান্ট কালাশনিকভ সবাইকে উদ্ধার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষার নির্দেশ দেন । এছাড়া তাদের জন্য আর কিছু করার ও ছিল না ।

কেননা, তারা যদি ৩৩০ ফুট নিচ থেকে অক্সিজেন মাস্ক ব্যবহার করতেও চায়, তবুও পানির প্রচন্ড চাপে হৃদপিন্ড বন্ধ হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হতে হবে । দুর্ঘটনার ৩০ ঘণ্টা পর মূল উদ্ধার অভিযান শুরু হয় । সমুদ্রেও ঝড় বইতে শুরু করে যার ফলে উদ্ধারকার্য সাময়িক বন্ধ রাখতে হয় । সাবমেরিনটি ছিল উচ্চতায় চারতলা সমান । ফলে কম্পার্টমেন্টগুলোতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন থাকাটাই স্বাভাবিক । কিন্তু সাবমেরিনের বিভিন্ন অংশে আগুন ধরে যাওয়ায় অতিদ্রুত অক্সিজেন কমে যাচ্ছিল ।

দুর্ঘটনার অষ্টম দিন “নরম্যান্ড পাইয়োনিয়ার” রেসকিউ-সাবমেরিন নিয়ে উদ্ধারকারীরা কুরস্কের মূল অংশে পৌছায় । এর পর উদ্ধারের জন্য ভেতরে আটকে থাকা স্ক্রুদের জানান দেওয়ার চেষ্টা করা হয় । কিন্তু তখন অনেক বেশি দেরি হয়ে গেছে । অল্প কয়েক জন বাদে প্রায় সব নাবিককেই বরন করতে হয়েছে নির্মম পরিনতি৷

দুর্ঘটনার ১৪ মাস পর ৭ই অক্টবর, ২০০১ সালে হল্যান্ডের একটি উদ্ধারযান দিয়ে কুরস্ক কে ভূমিতে তুলে আনা হয়৷ সাবমেরিন কুরস্কের দুর্ঘটনা পৃথিবীর সবথেকে বড় নৌ দুর্ঘটনাগুলোর একটি৷ আর এর নাবিকেরা এমনভাবে মৃত্যুবরন করেছে যেটা তারা কখনও কল্পনাও করেনি৷ আমরা এটাই প্রার্থনা করি ভবিষ্যতে যেন আর কোন নাবিককে এরকম নির্মম পরিনতি বরন করতে না হয়৷

Tags
Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Close