বিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় সাবমেরিন দূর্ঘটনা
ইন্দোনেশিয়ার সাবমেরিন ডুবির ঘটনা গোটা বিশ্বেই আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে৷ মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় যেমন অধিকাংশ মানুষ শোকাহত হয়েছ, আবার অনেকের মনেই প্রশ্ন তৈরী হয়েছে, এই আধুনিক যুগে এসেও এতো বিশাল একটি সাবমেরিন হারিয়ে যায় কিভাবে? কিন্তু সাবমেরিন ডুবির ঘটনা এটিই প্রথম নয়৷ আমাদের আজকের ভিডিওটিতে অতীতে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু আলোচিত সাবমেরিন হারানোর ইতিহাস তুলে ধরবো৷ এগুলো কোন কোনটি খুবই মর্মান্তিক আবার কোন ঘটনার রহস্য আর পর্যন্ত জানা যায়নি৷ কোন সাবমেরিন আবার পারমানবিক রিএ্যাক্টর নিয়ে ডুবেছে৷ আর একটি সাবমেরিন এক মেগাটনে ক্ষমতাসম্পন্ন পারমানবিক বোমা নিয়ে সমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছে৷ রহস্য আর বিস্ময়ে ভরা এসব ঘটনা সম্পর্কে জানতে পুরো ভিডিওটির শেষ পর্যন্ত দেখতে থাকুন৷
প্রথমেই আসি আমেরিকান সাবমেরিন USS Thresher এর দিকে৷ এই সাবমেরিন হারানোর ঘটনাটি গোটা বিশ্বে সবথেকে হইচই ফেলে দিয়েছিল৷ কেননা এটি ছিল পারমানবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন৷ ১৯৬৩ সালের ১০ই এপ্রিল ক্যারিবিয়ান সাগরে সাবমেরিনটি দুর্ঘটনার কবলে পরে৷ এসময় এটা সমুদ্রের গভীরে ডুব দিয়ে অদৃশ্য থাকার অনুশীলন করছিলো৷ কিন্তু অনুশীলন করতে গিয়ে তারা চিরতরে অদৃশ্য হয়ে যায়৷ ধারনা করা হয় যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে এটা উপরে উঠার ক্ষমতা হারায়৷ পানির বেশি গভীরে চলে যাওয়া চাপে ধ্বংস হয়৷ এতে ১২৯ জন নাবিকের সবার মৃত্যু হয়৷ সাবমেরিন ধ্বংসে এটা এযাবতকালে দ্বিতীয় সর্বচ্চ মৃত্যুর ঘটনা৷ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হচ্ছে, এটা অনুশীলন করার সময় সাবমেরিন উদ্ধারকারী জাহাজ স্কাইলার্কককে সাথে নিয়েছিল৷ সাবমেরিনটির ঠিক উপরে স্কাইলার্ক থাকলেও ভয়ংকর সাগরে কোন কাজে আসেনি৷ এই দুর্ঘটনার ফলে সাগরের গভীরে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পারার আশংকা তৈরী হয়৷
এবারে আসি এযাবতকালে সবথেকে বেশি প্রাণহানী ঘটানো সাবমেরিন দুর্ঘটনার দিকে৷ এটি ছিল ফরাসি ক্রুইজার সাবমেরিন Surcouf. দীর্ঘদিন এটৈ বিশ্বের সবথেকে বড় সাবমেরিন ছিল৷ যেটাতে বিমানের জন্য হ্যাঙ্গারও ছিল৷ এটিও হারিয়েছে ক্যারিবিয়ান সাগরে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় ১৯৪২ সালের ১৮ অথবা ১৯ ফেব্রুয়ারিতে সাবমেরিনটি হারিয়ে যায়৷ ধারনা করা হয় আমেরিকান এক যুদ্ধজাহাজের সাথে ধাক্কা খেয়ে এর বিপর্যয় ঘটে৷ যাতে প্রাণ হারায় ১৩০ জন নাবিক৷ সাবমেরিনে এটা ইতিহাসে সবথেকে বড় প্রাণহানীর ঘটনা৷
এবারে আসি যে সাবমেরিন দুুর্ঘটনাটি ভ্লাদিমির পুতিনের সিংহাসন নরবরে করে দিয়েছিল৷ এটি হচ্ছে রাশিয়ার অস্কার ক্লাস সাবমেরিন কুরস্ক৷ পারমানবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন ক্রুইজ মিসাইল এবং টর্পেডো বহন করতো৷ এই সবমেরিনের ধ্বংস সবথেকে নির্মম ছিল৷ এটি ছিল শতাব্দির প্রথম সাবমেরিন দুর্ঘটনা৷ পুতিন ক্ষমতা নেওয়ার মাত্র তার মাস পর ২০০০ সালের আগষ্টে এই দুর্ঘটনা ঘটে৷ রাশিয়া সবথেকে শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজ পিটার দ্যা গ্রেটের সাথে মহড়ার সময় এর একটি টর্পেডোর বিস্ফোরন ঘটে৷ ফলশ্রুতিতে বাকি টর্পেডোগুলোও বিস্ফোরিত হয়৷ সাথে সাথে বেশ কিছু নাবিক প্রাণ হারায়৷ তবে অনেকেই জীবিত ছিল৷ সাবমেরিনটি উদ্ধারে ব্রিটেন এবং নরওয়ে সাহায্য করতে চাইলেও রাশিয়া রাজি হয়নি৷ ফলে সব নাবিকের মৃত্যু হয়৷ মোট ১১৮ জন নাবিক মারা যায়৷ এটা একবিংশ শতাব্দি এবং রাশিয়ার ইতাহাসে সবথেকে বড় প্রাণহানীর ঘটনা৷ ঐ সময় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সোচিতে ছুটি কাটাচ্ছিলেন৷ দুর্ঘটনা সত্তেও রাজধানীতে ফিরে না আসায় ব্যপক সমালোচনার মুখে পরেন৷ ক্ষমতা গ্রহণের চার মাসের মধ্যেই পদত্যাগের চাপে পরেন৷ পরে সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, তিনি ছুটি থেকে ফিরলেও সাবমেরিনের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হতো না৷
রাশিয়ার সাবমেরিন দুর্ঘটনার তিন বছর পর চীনের একটি সাবমেরিন দুর্ঘটনার কবলে পরে৷ এটি ছিল একটি মিঙ ক্লাস সাবমেরিন৷ উল্লেখ্য বাংলাদেশের সাবমেরিন দুটি একই ক্লাসের৷ ঐ সময় সাবমেরিনটি পীত সাগরে উত্তর কোরিয়াকে সাথে নিয়ে মহড়া দিচ্ছিল৷ এই সাবমেরিন দুর্ঘটনার সাথে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ইন্দোনেশিয়ার সাবমেরিনটির মিল রয়েছে৷ এখানেও অক্সিজেনের অভাবে ৭০ জন নাবিকের মৃত্যু হয়৷ এটা চীনের ইতিহাসে সবথেকে বড় সামরিক দুর্ঘটনা৷ দর্ঘটনার পর চীনা নৌবাহিনীর কমান্ডার এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিকে শাস্তি প্রধান করা হয়৷
পুরো ভিডিওটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন
এবারে আসি ইতিহাসের সবথেকে রহস্যময় সাবমেরিন দুর্ঘটনাটির দিকে৷ এটি মার্কিন সাবমেরিন USS Scorpion. এটিও একটি পারমানবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন৷ কোল্ড ওয়ারের সময় ১৯৬৮ সালে ভুমধ্যসাগরে এটা হারিয়ে যায়৷ ঐ বছরে ভুমধ্যসাগরে মোট তিনটি সাবমেরিন রহস্যজনকভাবে হারায়৷ সাবমেরিনটি হারানোর সময় সোভিয়েত সাবমেরিনের উপর নজরদারী করছিলো৷ দুর্ঘটনার কোন কারন জানা যায়নি কিংবা প্রকাশ করা হয়নি৷ এই দুর্ঘটনা ৯৯ জন নাবিকের সবাই মারা যায়৷
একই বছরে আরও তিনটি রহস্যজনক সাবমেরিন দুর্ঘটনা ঘটে৷ এর মধ্যে অন্যতম সোভিয়েত সাবমেরিন K 129. এটার সবথেকে ভয়ংকর বিষয়টি ছিল এটা পারমানবিক হামলায় সক্ষম ব্যলস্টিক মিসাইল বহন করছিলো৷ যার কারনে এই সাবমেরিন হারানো ভয়াবহ দুশ্চিন্তার জন্ম দেয়৷ তবে সেই দুশ্চিন্তা থেকে উদ্ধার করে CIA. CIA খুব গোপনেই ১৯৭৪ সালে এর আংশিক উদ্ধার করে৷ এই দুর্ঘটনায় ৮০ জনেরও বেশি নাবিকের প্রাণহানী ঘটে৷
একই বছরে আরও একটি আলোচিত সাবমেরিন হারানোর ঘটনা হচ্ছে, ইসরায়েলি সাবমেরিন INS Dakar হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা৷ ৬৯ জন নাবিক নিয়ে ভুমধ্যসাগরে হারিয়ে যায় এটি৷ ১৯৯৯ সালে গ্রিসের জলসীমায় এর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়৷ পানির ৩ হাজার মিটার গভীরে ডুবেছিল এটা৷ এখান পর্যন্ত সবথেকে গভীরে পৌছানো এবং ধ্বংস হওয়ার রেকর্ড এই সাবমেরিনটির৷
ঐ বছরে রহস্যময় ভাবে হারিয়ে যাওয়া সর্বশেষ সাবমেরিনটি হচ্ছে ফরাসি সাবমেরিন মিনার্ভে৷ ইসরায়েলের সাবমেনিরটি হারিয়ে যাওয়ার মাত্র দুদিন পরেই এটি নিখোজ হয়৷ এটি একেবারেই নতুন একটি সাবমেরিন ছিল৷ এই সাবমেরিনটিও ভুমধ্যসাগরে হারিয়ে যায়৷ ঐ সময় এতে ৫২ জন নাবিক ছিল৷ এই সাবমেরিনটির নির্মম বিষয় ছিল, খারাপ আবহাওয়ার কারনে এটা তার বন্দর তুলোনে যাচ্ছিল৷ হারিয়ে যাওয়ার ৫০ বছর পর ২০১৯ সালে এর ধ্বংসাবশেষ খুজে পাওয়া যায়৷ আর মাত্র ৪৫ কিলোমিটার পরেই সাবমেরিনটি গন্তব্যে পৌছাতো৷
তবে সাগরে হারিয়া যাওয়া সর্বশেষ সাবমেরিনটি ছিল, আর্জেন্টিনার সাবমেরিন ARA San Juan. ২০১৬ সালে সাবমেরিনটি দক্ষিণ আটলান্টিক সাগরের কনকনে ঠান্ডা পানিতে হারিয়ে যায়৷ ঐ সময় সাবমেরিনটিতে ৪৪জন নাবিক ছিল৷ যার মধ্যে ৩৫ বছর বয়সি আমেরিকার প্রথম নারী সাবমেরিন অফিসার এলিয়েনাও ছিলেন৷ ধারনা করা হয় বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারনেই সাবমেরিনটি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল৷ দুর্ঘটনার ১ বছর পর পানির ৯শ ফিট গভীরে সাবমেরিনটির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়৷
প্রিয় দর্শক, সাবমেরিন হারানোর এই ঘটনাগুলো জানার পর সাবমেরিনের মিশন কতটা ঝুকিপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে?