
গ্রিস আর তুরস্ক, দুই জনম জনমের শত্রু! গ্রিক মিথলজির ঐতিহাসিক ট্রয়ের যুদ্ধের কথা আমরা সবাই জানি৷ টেক দুনিয়া আজকে থেকে তিন হাজার বছর আগের কথিত এই ট্রজান ওয়ার বা ট্রয়ের যুদ্ধে গ্রিসের এথেন্স স্পার্ট সব একত্রিত হয়ে আক্রমণ করেছিল তুরস্কের ট্রয় নগরীকে৷ সেই প্রাচীন কাল থেকেই আজ পর্যন্ত গ্রিস এবং তুস্কের মধ্যে যুদ্ধ এবং শত্রুতা চলে আসছে৷ কখনও খ্রিস্টান রোমান বা বাইজেন্টাইন সম্রাজ্যের অধীনে তুর্কিরা গ্রিকদের দ্বারা শাসিত হয়েছে, আবার কখনওবা মুসলিম অটোমান সম্রাজ্যের অধীনে গ্রীকরা তুর্কিদের দ্বারা শাসিত হয়েছে৷ উনবিংশ শতাব্দিতে গ্রিস তুরস্ক থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ২০০ বছর ধরে বিভিন্ন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়েছে৷ এমনকি দুই দেশ ন্যাটোভুক্ত হওয়ার পরও প্রায়ই একে অপরের বিমান এবং যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে থাকে৷ দুই দেশের মিত্র আমরিকা, ন্যাটো কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়ন কোনভাবেই এর মিমাংসা করতে পারে না৷ আবার গ্রীসের তুলনায় তুরস্ক শক্তিশালী হওয়া সত্তেও গ্রিকদের বিরুদ্ধে তুর্কিরা খুব একটা সুবিধা করতে পারে না৷
আমাদের আজকের ভিডিওটিতে গ্রিস আর তুরস্কের সংঘাতের কারনগুলো এবং দুই দেশের সামরিকশক্তির তুলনা তুলে ধরবো৷ পাশাপাশি ভবিষ্যতে কি ঘটতে পারে এবং অতীতে এই দুই দেশের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষগুলো নিয়ে আলোচনা করবো৷
গ্রিস এবং তুরস্কের অবস্থান ভুমধ্যসীগরের উত্তরপূর্ব অংশে৷ দুই দেশের মধ্যে বিশাল সীমান্ত রয়েছে৷
গ্রিস এবং তুরস্কের দ্বন্দের প্রধান দুটি কারন হচ্ছে ভৌগলিক অবস্থান এবং ধর্ম৷ গ্রিকরা অর্থডক্স খ্রিস্টান৷ অপরদিকে তুর্কিরা সুন্নি মুসলিম৷ বিশেষ করে হাজিয়া সোফিয়া একটা বড় ইস্যু৷ যেটা মুলত গ্রিক অর্থডক্স ক্যাথড্রেল হিসেবে নির্মিত হলেও পরবর্তিতে অটোমান সুলতান মেহমেত বা দ্বিতীয় মুহাম্মাদ এটাকে ইম্পেরিয়াল মসজিদে রূপান্তরিত করে৷ এছাড়া খ্রিস্টান এবং মুসলিম অধ্যুষিত সাইপ্রাসকে নিয়ে গ্রিস আর তুরস্কের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে৷ যার ফলাফল হিসেবে সাইপ্রাস দুইভাবে বিভক্ত৷
ব্লাক সী বা কৃষ্ণ সাগরের সাথে ভুমধ্যে সাগরের যোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে এই দুই দেশের উপর নির্ভরশীল৷ তুরস্কের মধ্যে দিয়ে রয়েছে বসফরাস প্রণালীর প্রসারিত রূপ তুর্কি প্রণালী৷ অপদিকে গ্রিসের দখলে আছে এজিয়ান সাগর৷ যার কারনে রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো তুরস্ক এবং গ্রিসের উপর নির্ভরশীল৷ আবার তুরস্ক থেকে বের হওয়ার পথ এজিয়ান সী গ্রিকদের মালিকানাধীন৷ কিন্তু তুরস্ক এজিয়ান সাগরের বড় একটা অংশকে নিজেদের দাবী করে আসছে৷ সেইসাতে এর নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে৷ তবে শক্তিতে এগিয়ে থাকলেও তুরস্ক সুবিধা করতে পারছে না৷

সর্বশেষ শরনার্থী সংকট নিয়ে গ্রিস আর তুরস্কের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌছায়৷ তুরস্ক প্রায়ই গ্রিস সীমান্তে শরনার্থীর ঢল নামিয়ে গ্রিস এবং ইউরোপকে বেকায়দায় ফেলে দেয়৷
এবারে আসুন দেখে নেই দুই দেশের সামরিকশক্তির তুলনা৷ গ্রিস এবং তুরস্ক দুই দেশই ন্যাটোভুক্ত৷ তারা একই সাথে ১৯৫২ সালে ন্যাটোতে যোগ দেয়৷
গ্রিসের সামরিক বাজেট ৪.৮৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার৷ তাদের বাহিনীতে এক্টিভ সৈন্য আছে ২ লাখ৷ আর রিজার্ভে আছে আরও সাড়ে ৫ লাখ৷ গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ২০২০ সালের রেংকিংয়ে গ্রিসের অবস্থান ৩৩ নাম্বারে৷
বিপরীতে তুরস্কের সামরিক বাজেট ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার৷ তুরস্কের হাতে সক্রিয় সৈন্য আছে ৩ লাখ ৫৫ হাজার৷ রিজার্ভে আছে আরও ৩ লাখ ৮০ হাজার৷ সৈন্য সংখ্যায় তুরস্ক ন্যাটোর দ্বিতীয় বৃহত্তম ফোর্স৷ ২০২০ সালের গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের রেংকিংয়ে তুরস্কের অবস্থান ১১ নাম্বারে৷ অর্থাৎ সামরিক বাজেট, সৈন্য সংখ্যা এবং রেংকিংয়ে গ্রিসের থেকে তুরস্ক অনেক বেশি এগিয়ে৷
গ্রিসের হাতে ট্যাংক আছে ১৩৫৫টি৷ গ্রিসের সবথেকে শক্তিশালী ট্যাংক হচ্ছে জার্মানি তৈরী লিওপার্ড 2 মেইন ব্যাটল ট্যাংক৷ সাড়ে ৩শর উপরে লিওপার্ড 2 ট্যাংক আছে গ্রিসের হাতে৷ জার্মানির কাছে লাইসেন্স নিয়ে গ্রিস নিজ দেশেই অর্ধেক উৎপাদন করেছে৷ এছাড়াও লিওপার্ড 1 আছে ৫০০টি এবং আমেরিকান প্যাটন আছে আরও ৫০০টি৷
বিপরীতে তুরস্কের হাতে ট্যাংক আছে আড়াই হাজারের উপরে৷ গ্রিসের মতো তুরস্কেরও সবথেকে শক্তিশালী ট্যাংক হচ্ছে জার্মানির তৈরী ৩৪২টি লিওপার্ড 2 মেইন ব্যাটল ট্যাংক৷ গ্রীসের মতোই তুরস্কের বাকি ট্যাংকগুলো হচ্ছে লিওপার্ড 1 এবং আমেরিকার প্যাটন৷ তবে তুরস্কের প্যাটন ট্যাংকগুলো ইসরায়েলের কাছে আপগ্রেড করা৷ সম্প্রতি তুরস্ক নিজ দেশে আলটাই ট্যাংক তৈরী করছে৷ দক্ষিন কোরিয়ার হুন্দাই কোম্পানি K2 Black Panther ট্যাংকের প্রযুক্তিতে ভর করে তৈরী করা হয়েছে এগুলোকে৷ শক্তিশালী এই ট্যাংকগুলো ২০২৩ সাল নাগাদ তুরস্কের সেনাবাহিনীর মেরুদন্ডে পরিনত হবে৷ ট্যাংক বহরে তুরস্ক আর গ্রীস সমান প্রযুক্তির হলেও সংখ্যার দিক থেকে তুরস্ক এগিয়ে৷
সেনাবাহিনীর মতো বিমানবাহিনীতেও গ্রিস এবং তুরস্ক দুই দেশই আমেরিকান F 16 এবং F 4 phantom বিমান সার্ভিসে রেখেছে৷ তুরস্কের হাতে এফ 16 মাল্টিরোল ফাইটার রয়েছে ২৪৫টি৷ তুরস্ক নিজ দেশেই এগুলোর উৎপাদন করে৷ এছাড়াও তুরস্কের কাছে ৪৮টি এফ 4 ফ্যান্টম ফাইটার বোম্বার বিমান রয়েছে৷ তুরস্ক ইসরায়েলের কাছে এগুলোকে টার্মিনেটর ভার্সনে উন্নত করেছে৷
অপরদিকে গ্রিসের কাছে এফ 16 আছে ১৫৩টি৷ আর এফ 4 ফ্যান্টম আছে ৩৩টি৷ তবে গ্রিসের হাতে থাকা ফ্রান্সের তৈরী ২৪ মিরাজ 2000 বিমান গ্রিসকে এগিয়ে রেখেছে৷ এগুলো F 16 এবং মিগ 29 এর সমান ক্ষমতা সম্পন্ন ফোর্থ জেনারেশন ফাইটার৷ ১৯৯৬ সালে গ্রিসের মিরাজ 2000 বিমান তুরস্কের একটি F 16 কে ধ্বংস করে৷ তুরস্ক এবং গ্রিস বিভিন্ন সময় এজিয়ান সাগরের উপরে পরস্পরের বিমান ধ্বংস করে থাকে৷ এমনকি একবার তুরস্ক একটি F 16 এবং গ্রিসের একটি F 16 বিমান মুখোমুখি হলে কেউই উপর লেভেল থেকে মিসাইল নিক্ষেপের অনুমতি না পেয়ে ডগফাইট ডগফাইট খেলায় জড়িয়ে পরে৷ এ সময় আকাশেই সংঘর্ষ ঘটে দুটো বিমানই ধ্বংস হয়েছিল৷
তুরস্কের হাতে এ্যাটাক হেলিকপ্টার হিসেবে আছে আমেরিকান কোবরা৷ সেই সাথে যুক্ত হয়ে ইতালিয়ান প্রযুক্তিতে ভর করে নিজ দেশেই উৎপাদিত TAI 129. বিপরীতে গ্রীসের কাছে আছে এ্যাপাচি৷ এক্ষেত্রে তুরস্কের থেকে গ্রিস এগিয়ে৷
তবে তুরস্কের হাতে টিবি 2 এবং TAI Anka এ্যাটাক ড্রোন থাকলেও গ্রিসের কাছে এমন কিছুই নেই৷ পাশাপাশি তুরস্কের হাতে রাশিয়া তৈরী S 400 মিসাইল রয়েছে৷ এগুলো তুরস্ককে গ্রিসের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী করে তুলেছে৷
সেনাবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর মতো নৌবাহিনীতেও গ্রীস আর তুরস্ক মিল রেখেই সাবমেরিন কিনেছে৷ গ্রিস এবং তুরস্ক দুই দেশেরই হাতে রয়েছে জার্মানির তৈরী Type 209 এ্যাটাক সাবমেরিন৷ তুরস্কের হাতে এধরনের সাবমেরিন আছে ১২টি৷ অপরদিকে গ্রিসের কাছে আছে ৭টি৷ এছাড়াও গ্রিসের কাছে আরও ৪টি Type 214 এ্যাটাক সাবমেরিন রয়েছে৷ এছাড়াও গ্রিসের কাছে ১৩টি ফ্রিগেইট আছে৷ তবে কোন করভেট নেই৷
বিপরীতে তুরস্কের কাছে ফ্রিগেইট জাহাজ আছে ১৬টি৷ আর করভেট আছে ১০টি৷ তুরস্ক তাদের আডা ক্লাস করভেটকে স্টিল্থ করভেট বলে দাবী করে৷
পুরো ভিডিওটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন
বিগত কয়েক বছরে অস্ত্র নির্মান শিল্প এবং প্রযুক্তিতে তুরস্ক অনেক বেশি এগিয়ে গিয়েছে৷ তারা নিজ দেশেই বিমান ড্রোন ট্যাংক এবং যুদ্ধ জাহাজ তৈরী করছে৷ সেই সাথে বিভিন্ন ধরনের মিসাইল তৈরীর করে যাচ্ছে প্রতিনিয়নই৷ বিপরীতে গ্রিসের এধরনের কোন লক্ষণ নেই৷ তুরস্ক আমেরিকার নিউরক্লিয়ার পাওয়ার শেয়ারং চুক্তির অংশিদার৷ ফলে তুরস্কের কাছে পারমানবিক বোমা আছে৷ তবে গ্রিস ন্যাটোভুক্ত হওয়ায় তুরস্ক এই বোমা কখনও গ্রিসের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবে না৷ অবশ্য সম্প্রতি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান নিজ দেশেই এবং নিজস্ব প্রযুক্তিতে পারমানবিক বোমা উৎপাদনের ঈঙ্গিত দিয়েছেন৷ এছাড়াও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্ক রাশিয়া কিংবা ফ্রান্সের মতো সুপার পাওয়ারগুলোর সাথে টেক্কা দিচ্ছে৷ বিপরীতে গ্রীসকে অর্থনৈতিক সংকট সামাল দিতে হচ্ছে৷ তারপরও বিভিন্ন যুদ্ধে তুরস্ক গ্রীসের বিরুদ্ধে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি৷
আধুনিককালে তুরস্ক আর গ্রিসের সংঘাতটা শুরু হয় ১৮২১ সালে গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে৷ মূলত অটোমান সম্রাজ্য থেকে আলাদা হতে গ্রিকরা বিদ্রোহ শুরু করে৷ গ্রিকদের পাশে দাড়ায় রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রোমানিয়া এবং সার্বিয়া৷ বিপরীতে তুর্কি অটোমানদের পক্ষে ছিল মিশর, লিবিয়া, আলজেরিয়া এবং তিউনিশিয়ার মতো উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলো৷ সাড়ে ৮ বছর ধরে চলা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অটোমানদের পরাজিত করে গ্রিস স্বাধীনতা লাভ করে৷
ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এর একশো বছর পর উল্টো তুরস্ককেই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য গ্রিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাওয়া ভগ্নপ্রায় অটোমান সম্রাজ্যের মূল ভুখন্ড আনাতোলিয়ায় আক্রমণ চালায় গ্রিস৷ একই সময় তুরস্কের পূর্ব দিকে আক্রমণ চালায় আর্মেনিয়া এবং দক্ষিণে আক্রমণ চালায় ফ্রান্স৷ গ্রিস, আর্মেনিয়া এবং ফ্রান্সে সমর্থনে এগিয়ে আসে ব্রিটেন এবং আমেরিকা৷ তুরস্কের জনক মোস্তফা কামাল পাশা একাই নিজ বাহিনীকে নিয়ে গ্রিস, আর্মেনিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেনসহ মিত্রবাহিনীকে পরাজিত করে তুরস্কের মূল ভুখন্ডকে রক্ষা করে এবং গুরুত্বপূর্ণ ইস্তানবুলকে তুরস্কের দখলে রাখে৷
প্রিয় দর্শক, তুরস্কের ঐতিহাসিক শত্রু গ্রিস, রাশিয়া, আমেরিকা, ফ্রান্স এবং ব্রিটেন বর্তমানে একই সময়ে তুরস্কের বিরুদ্ধে দাড়িয়েছে৷ নতুন করে সাথে যোগ হয়েছে ইসরায়েল৷ যার কারনে লিবিয়া, সাইপ্রাস এবং গ্রিক-তুর্কি সীমান্ত ইসুতে তুরস্ক বেশ চাপেই আছে৷ তুরস্ক কি পারবে এতোগুলো শত্রুর মোকাবেলা করতে? আপনার মতামত কমেন্টে জানান৷
টেক দুনিয়ায় প্রকাশিত লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।