তুরস্ক বনাম ফ্রান্স নৌবাহিনী। ন্যাটো জোটের দুই শক্তিশালী দেশ
ইউরোপের দুই শক্তিধর দেশ তুরস্ক এবং ফ্রান্স৷ ন্যাটো জোটের দুই দেশের রয়েছে ভুমধ্যসাগরে বিশাল প্রভাব৷ টেক দুনিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোমান বা তুরস্কের কাছে থেকে সিরিয়া আলজেরিয়াসহ বিশাল ভুখন্ড দখলে নেয় ফ্রান্স বা ফরাসি সম্রাজ্য৷ দুই দেশের ঐতিহাসিক শত্রুতা একশো বছর ধরে চাপা থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা আবারও চরম আকার ধারন করেছে৷ বিশেষ করে লিবিয়া ইস্যূ নিয়ে তুরস্কের সাথে ঝামেলার কারনে ন্যাটো জোটের নৌ মহড়া থেকে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে ফ্রান্স৷ কেননা তুরস্ক আর ফ্রান্সের বিবাদ যুদ্ধে রূপ নিলে প্রথমেই তা ভুমধ্যসাগরে থাকা তাদের নৌবাহিনী মধ্যেই শুরু হবে৷
তুরস্ক এবং ফ্রান্স নৌবাহিনীর শক্তির তুলনা করতে আমরা তিনটি বিষয় আলোচনা করবো৷ এগুলো হচ্ছে, ভৌগলিক অবস্থান, যুদ্ধ জাহাজ ও যুদ্ধাস্ত্র এবং কে কোন কোন দেশকে পাশে পাবে৷
প্রথমেই আসি ভৌগলিক অবস্থানের তুলনায়৷ তুরস্কের অবস্থান ভুমধ্যসাগরের উত্তরপূর্ব দিকে৷ আর ফ্রান্সের অবস্থান ভুমধ্যসাগরের পশ্চিমাংশে৷ তুরস্কের এ্যাডভান্টেজ হচ্ছে ইস্তানবুলের মধ্য দিয়ে বসফরাস প্রণালী প্রবাহিত হয়েছে৷ ভুমধ্যসাগর এবং কৃষ্ণ সাগরকে যুক্ত করা এই প্রণালিটির উপরে রাশিয়াসহ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো নির্ভরশীল৷ এদিকে ফ্রান্সের এ্যাডভান্টেজ হচ্ছে তাদের খুব কাছেই জিব্রাল্টার প্রণালি অবস্থিত৷ আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে ভুমধ্যসাগরকে যুক্ত করা এই সাগরটিকে ভুমধ্যসাগরের প্রবেশপথ ধরা হয়৷+
এবারে আসি দুই দেশের যুদ্ধজাহাজ এবং সাবমেরিনের বর্ণনায়৷ ফ্রান্সের কাছে এয়ারক্রাফট কেরিয়ার বা বিমানবাহি যুদ্ধ জাহাজ আছে চারটি৷ এদের মধ্যে চার্লস ডি গল সবথেকে বড়৷ আমেরিকার এয়ারক্রাফট কেরিয়ারগুলো বাদে এটাই কোন পারমানবিক শক্তিচালিত এয়ারক্রাফট কেরিয়ার৷ এয়ারক্রাফট কেরিয়ারটিতে ৪০টি রাফাল ফাইটার বিমানের M ভার্সন থাকতে পারে৷ এছাড়াও আরও ৭টি অন্যান্য বিমান এবং হেলিকপ্টার বহন করতে পারে৷ যুদ্ধবিমানের সক্ষমতা তুলনায় কারও কারও মতে এটাই বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী এয়ার ক্রাফট কেরিয়ার৷ জাহাজটিকে নিয়ে আরও বিস্তারিত জানতে এই জাহাজের উপর আমাদের চ্যানেলের ভিডিওটি দেখুন৷ ফ্রান্সের বাকি ৩টি এয়ারক্রাফট কেরিয়ার হচ্ছে মিস্ট্রাল ক্লাস৷ এগুলোর প্রত্যেকটি ১৬ থেকে ৩৫টি হেলিকপ্টার বহন করতে পারে৷ জাহাজগুলোর সফলতার জন্যও রাশিয়াও ফ্রান্সের কাছে দুটি জাহাজ কেনার অর্ডার করেছিল৷ যেগুলো পরবর্তিতে মিশর কিনে নেয়৷ এদিকে তুরস্কের কাছে এখন পর্যন্ত এরকম কোন জাহাজ সার্ভিসে নেই৷ তবে তুরস্ক ফ্রান্সের মিস্ট্রাল ক্লাসের সমতুল্য আনাদলু নামের হেলিকপ্টাবাহি এয়ারক্রাফট কেরিয়ার তৈরীর কাজ শেষ করেছে৷ এটা যেকোন সময় সার্ভিসে আসবে৷
এবারে নৌবাহিনীর সবথেকে ভয়ংকর জাহাজ ডেস্ট্রয়ারের তুলনায় আসা যাক৷ ফ্রান্সের কাছে ডেস্ট্রয়ার আছে ১১টি৷ এদের মধ্যে ৩টি হরাইজন ক্লাস এবং ১টি ক্যাসার্ড ক্লাস ডেস্টরয়ার এয়ার ডিফেন্সের কাজে ব্যবহার করা হয়৷ বাকি ডেস্ট্রয়ারগুলো সাবমেরিন ধ্বংসের জন্য তৈরী করা হয়েছে৷ বিপরীতে তুরস্কের কাছে এধরনের কোন ডেস্ট্রয়ার নেই৷ তবে তুরস্ক TF2000 ক্লাস নামের ৮টি ডেস্ট্রয়ার তৈরীর প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে৷ এগুলো এয়ার ডিফেন্সের কাজে ব্যবহৃত হবে৷
ডেসট্রয়ারের থেকে কম ক্ষমতাসম্পন্ন ফ্রিগেইট এবং করভেটের দিক থেকে তুরস্ক এগিয়ে৷ তুরস্কের কাছে ১৬টি ফ্রিগেট আছে৷ এদের মধ্যে ৮টি G ক্লাস ফ্রিগেইট আমেরিকার তৈরী৷ এগুলো গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেইট৷ এগুলোতে ৮০টির উপরে মিসাইল থাকতে পারে৷ তুরস্কের বাকি ফ্রিগেইটগুলো জার্মানির তৈরী৷ এদের মধ্যে ৪টি বারবারোস ক্লাস ফ্রিগেইট এবং বাকি ইয়াভুজ ক্লাস ফ্রিগেইট৷ ফ্রিগেইট ছাড়াও করভেট জাহাজ আছে ১০টি৷ তুরস্ক মিলগেজ প্রজেক্টের অধীনে নিজস্ব প্রযুক্তিতে ৪টি আডা ক্লাস করভেট তৈরী করেছে৷ তুরস্কের দাবী এগুলো স্টিল্থ করভেট৷ তুরস্কের বাকি ৬টি B class করভেটও নিজ দেশেই তৈরী
বিপরীতে ফ্রান্সের হাতে ১১টি ফ্রিগেইট আছে৷ এদের মধ্যে ৫টি লা ফায়েত্যে ক্লাস ফ্রিগেইট তুলনামুলক বেশি শক্তিশালী৷ ফ্রান্সের কাছে কোন করভেট নেই৷
এবারে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ তুলনা সাবমেরিনের দিকে আসা যাক৷ তুরস্কের হাতে সাবমেরিন আছে ১১টি৷ সবগুলো জার্মামি তৈরী Type 209 এর বিভিন্ন ভার্সন৷ এগুলো মুলত ডিজেল এ্যাটাক সাবমেরিন৷ এগুলো বিশ্বের সবথেকে বেশি ব্যবহৃত এবং সফল সাবমেরিন৷
বিপরীতে ফ্রান্সের কাছে সাবমেরিন আছে ৯টি৷ এদের মধ্যে ৫টি রুবিস ক্লাস হচ্ছে পারমানবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন৷ কিন্তু ফ্রান্সের বাকি চারটি ট্রিওমফ্যান্ট ক্লাস সাবমেরিন তুরস্ক আর ফ্রান্সের মধ্যে বিরাট পার্থক্য তৈরী করে দিবে! এগুলো পারমানবিক হামলায় সক্ষম ব্যলস্টিক মিসাইলবাহি সাবমেরিন! প্রতিটি সাবমেরিনে ১৬টি করে M45 অথবা M51 ব্যালস্টিক মিসাইল থাকতে পারে৷ অর্থাৎ ১৬টি সাবমেরিনে ৬৪টি মিসাইল রয়েছে৷ প্রতিটি মিসাইলের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা হিরোশিমার থেকে ৭০ গুণ বেশি হতে পারে! ফ্রান্স ছাড়া কেবল মাত্র আমেরিকা, রাশিয়া এবং চীন নিজস্ব প্রযুক্তিতে এধরনের সাবমেরিন ও মিসাইল নির্মান করতে পেরেছে৷ তুরস্ক আর ফ্রান্সে মধ্য যদি যুদ্ধ লাগে, ফ্রান্সের কেবলমাত্র এই সাবমেরিনগুলো হামলা করলেই তুরস্ক হিরোশিমায় পরিনত হবে!
তবে তুরস্কের কাছে ন্যাটোর নিউক্লায়ার ওয়েপন শেয়ারিং চুক্তির অধীনে আমেরিকার পারমানবিক বোমা আছে৷ যেগুলো F 16 বিমান থেকে নিক্ষেপ করা যায়৷
সব শেষে আসি বন্ধু তালিকায়৷ তুরস্ক আর ফ্রান্সের মধ্যে সংঘাত তৈরী হলে তুরস্কের পাশে থাকবে ইতালি৷ কেননা ইতালির সাথে ফ্রান্সের বৈরীতা এবং তুরস্কের বন্ধুত্ব আছে৷ এর পরপরই তুস্কের পাশে পাকিস্তানসহ আরববিশ্বের কিছু মুসলিম দেশ থাকতে পারে৷ বিপরীতে ফ্রান্সের পক্ষে সবার আগে থাকবে গ্রিস৷ কেননা ফ্রান্সের থেকেও গ্রিস তুরস্কের সবথেকে বড় শত্রু৷ এছাড়াও ইসরায়েল, জার্মানি এবং স্পেনও থাকতে পারে৷ তবে আমেরিকা, রাশিয়া এবং ব্রিটেনের মতো প্রভাবশালী দেশের নিরপেক্ষ থাকার সম্ভাবনাই বেশি৷
প্রিয় দর্শক, ফরাসি নৌবাহিনীর তুলনায় তুরস্ক একেবারেই দুর্বল৷ যদিও সম্প্রতি তারা নৌশক্তি বাড়ানোর চেষ্ট করছে৷ এই অবস্থায় ফ্রান্স তুরস্ক যুদ্ধ লাগলে কি পরিণতি হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?