ইরানের F-14 Tomcat ভয়ংকর যুদ্ধ বিমান
এটা ২০১৫ সালে সিরিয়ার যুদ্ধের দৃশ্য৷ এখানে একটি রাশিয়ান Tu 160 বোমারু বিমান বোম্বিংয়ের জন্য উড়ছে৷ আর রাশিয়ান বিমানটির নিরাপত্তা দিচ্ছে আমেরিকার তৈরী একটি ইরানি F 14 বিমান৷ ১৯৮৮ সালে পারস্য সাগরে আমেরিকার নৌবাহিনী ইরানের F 14 বিমান ভেবে আতংকিত হয়ে একটি যাত্রীবাহি বিমানকে ধ্বংস করে৷ আমেরিকান নৌবাহিনীর আতংক আর বিভ্রান্ত হওয়া দেখেই বুঝা যায় কতটা ভয়ংকর ছিল এই বিমানটি! ইরান ইরাক যুদ্ধে শুধু এই বিমানগুলো ব্যবহার করে ইরাকের ১৬০টি যুদ্ধ বিমান ধ্বংস করেছিল ইরান! কিন্তু এর দুই যুগ পেরিয়ে বর্তমানে যুদ্ধের মাঠে কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে ইরানেই এই বিমানগুলো? এ বিষয়ে একটু টাচ দেওয়া যাক৷ ২০০৬ সালে আমেরিকা এই বিমানগুলো অবসরে পাঠানোর পর প্রায় সবগুলো বিমান ধ্বংস করে ফেলে৷ কারন তাদের ভয় ছিল ইরান অবসরে পাঠানো বিমানগুলো থেকে পার্টস চুরি করে তাদের F 14 গুলোতে ব্যবহার করবে! অবশ্য ইরানের ইঞ্জিনিয়াররাই এই বিমানগুলোকে আরও উন্নত করে তুলেছে৷
বিমানটিকে প্রথম তৈরী করা ১৯৭০ এর দশকে৷ আমেরিকার অন্য দুই বিখ্যাত ফাইটার F 15 ঈগল এবং F 16 ফাইটি ফ্যালকনের সাথেই এটাকে নির্মান করা হয়৷ আকৃতি, গতি, রাডারের রেঞ্জ এবং অস্ত্র পরিবহন ক্ষমতা এই সব দিক থেকেই F 14 বিমানটি F 15 এবং F 16 বিমানের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল৷ F 15 কে নির্মান করেছিল বোয়িংয়ে যুক্ত হওয়া ম্যাকডোনেল ডগলাস, F 16 কে তৈরী করেছিল লকহিডে যুক্ত হওয়া জেনারেল ডায়নামিক আর F 14 কে তৈরী করেছিল নর্থ্রুপ গ্রুম্যানে মার্জড হওয়া গ্রুম্যান কর্পোরেশন৷ যারা ইরানের F 14 কে পুরনো বলে তাচ্ছিল্য করে থাকেন, তাদের এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া উচিৎ৷ তবে F 15 এবং F 16 বিমান দুটি বিমান বাহিনীর জন্য তৈরী করা হলেও F 14 কে তৈরী করা হয়েছিল আমেরিকান নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজগুলোর জন্য৷ সোভিয়েত মিগ 25 সহ অন্যব বিমানগুলোর হুমকি ঠেকাতে এবং যুদ্ধ জাহাজগুলোর নিরাপত্তা দিতেই F 14 সার্ভিসে এনেছিল আমেরিকা৷ একইভাবে ১৯৭৪ সালে ইরাকের মিগ 25 বিমানের হুমকি থেকে বাঁচতে আমেরিকান ফাইটার কেনার সিদ্ধান্ত নেয় ইরানে রাজা মোহাম্মাদ রেজা পাহলাভি৷ ইরানের জন্য F 15 এবং F 14 এই দুই বিমানকে প্রদর্শন করে আমেরিকা৷ মোহাম্মাদ রেজা পাহলাভির কাছে F 14 এর ম্যানুভার ভালো লাগায় তিনি এগুলোই কেনার সিদ্ধান্ত নেন৷ ঐসময়ে ইরান মাত্র ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিনিময়ে ৩০টি F 14 এবং 424 টি AIM 54 Phoenix মিসাইল কেনার চুক্তি করে৷ পরবর্তিতে চুক্তির খরচ বাড়িয়ে ৮০টি F 14 এবং 714 টি AIM 54 Phoenix মিসাইল কিনে ইরান৷
চলুন বিমানটি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জেনে নেই৷ এটা বিশালাকৃতির ভ্যারিয়াবল সুইপ্টউইং বিমান৷ ভ্যারিয়ারবল সুইপ্ট উইং বলতে সেসব বিমানকে বুঝায় যেগুলো এদের ডানা সামনে পিছনে নড়াতে পারে৷ বিমানটি মাটিতে থাকার সময় কিংবা টেক অফ করার সময় ডানাগুলো বেশি করে মেলানো থাকে৷ এর ফলে সহজেই বিমানটি আকাশে উড়তে পারে৷ কিন্তু আকাশে গতি বাড়ানোর সময় এটা ডানাগুলোকে বডির কাছে নিয়ে আসে৷ এতে করে বিমানটি সরু আকৃতি ধারন করে৷ ফলে বাতাসের ঘর্ষন কম হয় এবং বিমানটি দ্রুত গতিতে ছুটতে পারে৷
বিমনাটির ১০টি হার্ড পয়েন্ট রয়েছে৷ এগুলোতে আকাশে অন্য বিমান ধ্বংস কিংবা ভুমিতে আক্রমণ দুই কাজের জন্যই অস্ত্র বহন করতে পারে বিমানটি৷ আকাশে শত্রুর বিমান ধ্বংসের জন্য ইরান এটায় AIM 54 Phoenix মিসাইল ব্যবহার করে৷ এটা আমেরিকার তৈরী সবথেকে দুরপাল্লার এয়ার টু এয়ার মিসাইল৷ এক্টিভ রাডার ট্রাকিং করে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরের বিমান ধ্বংস করতে পারে মিসাইলটি৷ একটি বিমানেই ৬টি এধরনের মিসাইল থাকতে পারে৷ একবার এক পরীক্ষায় আমেরিকান পাইটল মাত্র ৩৮ সেকেন্ডেই ৬টি মিসাইল লঞ্চ করেছিল! অর্থাৎ ৩৮ সেকেন্ডেই খরচ হয়েছিল সোয়া ২৪ কোটি বাংলাদেশি টাকা৷ যদিও বর্তমান সময়ে হলে এই খরচ আরও কয়েকগুণ বাড়তো৷ ইরান ইরাক যুদ্ধে এধরনের মিসাইল দিয়ে ৬২টি ইরাকি বিমান ধ্বংস করেছিল ইরানিরা৷ যার মধ্যে বিশ্বের সবথেকে দ্রুতগামী Mig 25 বিমানও রয়েছে৷ বুঝতেই পারছেন কিভাবে এখনও আমেরিকা বা পশ্চিমাদের জন্য F 14 বিমানটি আতংকের কারন হতে পারে৷
পুরো ভিডিও দেখতে এখানে ক্লিক করুন
এটা খুবই দ্রুত গতি একটি বিমান৷ দুই ইঞ্জিনের সাহায্যে বিমানটি ঘন্টায় প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটারেরও বেশি বেগে উড়তে পারে৷ মাত্র দেড় মিনিটেই বিমানটি ঘন্টায় ৯৯০ কিলোমিটার থেকে ঘন্টায় ২২০০ কিলোমিটার গতি তুলতে পারতো! এটা ইরানের সবথেকে দ্রুতগামী বিমান৷ দ্রুত গতি বিমানটিকে আকাশযুদ্ধে বাড়তি সুবিধা দেয়৷ বিমানটির কমব্যাট রেঞ্জ ৯৩০ কিলোমিটার৷ অর্থাৎ কয়েকটা বিমান দিয়ে পুরো ইরানের নিরপত্তা নিশ্চিৎ করতে সম্ভব৷
ইরান মোট ৮০টি বিমান কিনেছিল৷ যার ৭৯টি তাদের হাতে পৌছায়৷ ইরান ইরাক যুদ্ধে এই বিমানগুলো ইরাকি বিমান বাহিনী অধিকাংশ বিমান ধ্বংস করে ফেলেছিল৷ ইরান ইরাক যুদ্ধে ইরানিরা F 14 ব্যবহার করে ইরাকের ১৬০টি কিংবা তারও বেশি বিমান ধ্বংস করেছিল৷ ইরানের F 14 দিয়ে ধ্বংস করা ইরাকি বিমানগুলো হচ্ছে, ৫৭টি মিগ 23, ৩৩টি ফ্রান্সের তৈরী মিরেইজ F 1, ২৩টি মিগ 21, ২৩টি সুখোই 22, ৯টি কুখ্যাত মিগ 25, ৫টি Tu 22 বোম্বার, দুটি মিগ 27, একটি মিরেইজ 5 এবং ১টি Mi 24 এ্যাটাক হেলিকপ্টার৷ ইরানি পাইলট জালিল জানডি একাই এই বিমান নিয়ে ১১টি ইরাকি বিমান ধ্বংস করেছিল৷ গোটা পৃথিবীতে তিনিই F 14 এর সবথেকে সফল পাইলট৷
এর সৃষ্টিকারী আমেরিকাও এই বিমানটিকে প্রচন্ড ভয় পায়৷ ১৯৮৮ সালে আমেরিকান নৌবাহিনী একটি যাত্রীবাহি বিমানকে ভুলে ইরানের F 14 ভেবে আতংকিত হয়৷ সাথে সাথেই ভয়ে মিসাইল মেরে যাত্রীবাহি বিমানটিকে ধ্বংস করেছিল৷
আমেরিকা তাদের হাতে থাকা F 14 বিমানগুলোকে ২০০৬ সালে অবসরে পাঠায়৷ কিন্তু অবসরে পাঠানো পর অন্য বিমানগুলো মতো এগুলোকে বোনইয়ার্ডে না পাঠিয়ে বরং ধ্বংস করে৷ আমেরিকার শঙ্কা ছিল, অবসরপ্রাপ্ত বিমানগুলো থেকে ইরানিরা বিভিন্ন পার্টস চুরি করতে পারে৷ আবার অনেক বিশ্লেষক মনে করে থাকেন, ইরানের হাতে এই বিমান থাকায় ইরানিরা বিমানটির গোপনীয়তা জেনে গিয়েছে৷ যার কারনে আমেরিকা বিমানগুলোকে অবসরে পাঠিয়েছে৷ অবশ্য ইরান পরবর্তিতে অনেকবার বিমানগুলোর আপগ্রেড করেছে৷ ধারনা করা হয় বর্তমানে ইরানের কাছে ৪০ থেকে ৪৩টি F 14 আছে৷
প্রিয় দর্শক, ইরানের হাতে থাকা এই বিমানগুলোকে পুরাতন বলে অনেকেই তাচ্ছিল্য করে৷ কিন্তু এর সময়কার F 15 এবং F 16 বিমানগুলোকে এখনও আমেরিকা, ইসরায়েল, জাপান, তুরস্কসহ অন্যান্য দেশ আপগ্রেড করে অপারেট করছে৷ এদিকে ইরানও F 14 গুলোকে নিয়মিত আপগ্রেড করে চলেছে৷ এই অবস্থা যদি আবারও কখনও বিমানগুলোকে যুদ্ধের মাঠে নামতে হয়, তাহলে কি এগুলো আবারও আগের মতো সফলতা পাবে? নাকি পুরনো অচল মাল হিসেবে শত্রুর হাতে ধ্বংস হতে থাকবে?
টেক দুনিয়ায় প্রকাশিত লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।